ভূঁইয়া কামাল, মুলাদী (বরিশাল)।।
প্রকৃতির রূপে লাবণ্যে শ্যামল ছায়া বাংলাদেশের মাঠ-ঘাট, নদী-নালা ও বিলের পাড়ে বালুচরে পানির কলকলানিতে নীল আকাশে রূপালি তারায় ভরে উঠেছে কাশবন। ভাদ্র আর আশ্বিন মাস মিলে ‘শরৎকাল’; বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু। এই ঋতুতে বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপ ধারণ করে প্রকৃতি। নীল আকাশে ধবধবে পেঁজো তুলোর মতো মেঘ, আর মৃদু বাতাস। দেখা যাচ্ছে নীল আকাশ স্বচ্ছ সাদা মেঘ। আর সাদা মেঘের ভেলায় ভাসছে কাশফুলের ছোঁয়া। শরতের দিনে কখনো কাঠফাঁটা রোদ, আবার পরক্ষণেই ঝুম বৃষ্টি।
আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহ পেরোতেই প্রকৃতি সাজিয়ে নিয়েছে নিজেকে। দৃষ্টিনন্দন এ কাশফুলের রাজ্য এখন মুলাদী ডাক্তার ভুলু সেতুর পূর্বপাশে নয়াভাঙ্গনী নদীর তীরে বালুরমাঠটি। তার চারিদিক ঘিরে রয়েছে কাশফুল আর কাশফুল। শ্রাবণ মাস শেষে ভাদ্র মাসের শুরুতে তথা শরতের আগমনে বর্ষা ঋতুকে বিদায় জানিয়ে প্রকৃতি শরৎকালকে বরণ করে। আর শরৎকে স্বাগত জানাতে মেতে ওঠে কাশফুল।
নীল আকাশ জুড়ে অলস মেঘের অবাধ বিচরণ। খন্ড খন্ড মেঘের নিরুদ্দেশ যাত্রা। রোদের কলকানির পাশেই মেঘের ছায়া। মেঘ আর রোদের কানামাছি খেলার মাঝে বৃষ্টিও অংশ নিচ্ছে। এমন দিনে মুলাদীর বালুর মাঠে দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাতে কাশফুলের ‘সাদা ডালি’ সাজিয়ে বসে থাকে কাশবন। মাঠটির চারিদিকে কাশফুলগুলো মাথা নুয়ে আগতদের স্বাগত জানাচ্ছে। বালুর মধ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল দেখে মনে হবে, প্রকৃতি আপনার মনের প্রশান্তির জন্য এ রূপে সেজেছে। যত দূর চোখ যায়, তত দূর বিস্তৃত কাশের শুভ্রতা।
শরৎতের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ কাশফুল। আকাশের সাদা মেঘের সঙ্গে কাশফুলের মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া প্রকৃতিতে শুধুই মুগ্ধতা ছড়ায়। আর সেই শরৎতের কাশফুলে প্রাণমুগ্ধ হয়েছে ডাক্তার ভুলু সেতুর পূর্ব পার্শ্বে বালুর মাঠটি। মাঠটি কাশফুলে ভরে গেছে। কাশফুলের সৌন্দর্য মুগ্ধ করছে দর্শনার্থীদের। ছুটির দিনগুলোতে দেখা মিলে হাজারও দর্শনার্থীদের। পশ্চিম আকাশে সূর্য যাওয়ার পূর্বক্ষণে মাঠটিতে ভিড় বাড়ে দর্শনার্থীদের। কেউ বন্ধুদের সঙ্গে যায়, কেউবা প্রিয়তমাকে ও পরিবার পরিজন নিয়ে। হালকা বাতাসে কাশফুলের দোলের মাঝে নিজেদেরকে বিলিয়ে দেয়। তখনই ছবি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। কেউ সেলফি তুলছেন আবার কেউবা ভিডিও করছেন। আবার কেউবা সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেমবন্দি ছবি যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে জানান দেয় শরৎ এসেছে ধরায়৷
শরৎতের এই দৃষ্টিনন্দন দিনে মুলাদীর এই বালুর মাঠটি হয়ে ওঠে এক আনন্দের, প্রাণের মেলায় এমনটায় অনূভূতি প্রকাশ করছিলেন হিজলা উপজেলা থেকে আসা নিহাদ, শারমিন, সাবিহা, মুলাদী সদর থেকে আসা স্বর্ণালী, আলিফুন, মুমিনুল, জান্নাত, আতকিয়া বুশরা, সোলায়মান, তাইয়্যেবা, বিশ্বাসী ও হিরা মুক্তা বলেন, কাশফুলের কাছে এসে খুবই আনন্দ পাচ্ছি। মনকে পরিস্কারের জন্য এখানে আসি। কাশফুলের সান্নিধ্য পাওয়াটা একটু বাড়তি বিনোদন। অবসর সময়টা কাটানোর ভিন্ন একটা স্থান কাশফুলে ঘেরা এ প্রকৃতি। আরেকটা বিষয় আমাদের খুব ভালো লাগে সেটা হচ্ছে, নদীর উপরে সেতু আর তারই পাশে কাশফুলের রাজ্য। বিষয়টি দেখতেও বেশ রোমাঞ্চকর।
ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে আসা দর্শনার্থী ডাক্তার নাসরিন সুলতানা দিপা বলেন, শহর অঞ্চলে এ রকম দৃশ্য দেখা যায়নি। শহর থেকে দূরে গ্রাম অঞ্চলে নিরিবীলি পরিবেশে নদীর পাড়ে বালুর মাঠটির চারিদিকে কাশফুল দেখতে অনেক সুন্দর। কাশফুলে ঘেরা বালুর মাঠের মাঝখানে চারিদিক তিন স্তরে কাটাতারের বেস্টুনি দিয়ে সুরক্ষিত রয়েছে গ্যাস ও তৈল অনুসন্ধানকারী ক্যাম্প। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সব মিলিয়ে চমৎকার দৃশ্য। এসে এখানে পেলাম চমৎকার দারুচিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। দোতালার রেস্টুরেন্ট থেকে দেখা যায় কাশফুলের অপরূপ দৃশ্য। দেখা যায় নদীর পাড়ে নয়নাভিরাম মসজিদ ও ডাক্তার ভুলু সেতুটি। এতে করে দর্শনার্থীদের জন্য বাড়তি সুবিধা হলো-আনন্দভ্রমণ শেষে দারুচিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে এসে ক্লান্তি দূর করতে পারবেন। একই সঙ্গে খেতে পারবেন হরেক রকম সুস্বাধু খাবার।
উপজেলার প্রবীণ ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট ব্যাংকার আলহাজ্ব মোঃ খলিলুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, আগে পথে প্রান্তরে যেখানে সেখানে দেখা মিলত কাশফুলের। কিন্তু মানুষ বাড়ছে। বর্ধিত মানুষের খাদ্যের জোগান দিতে পতিত জমিও চলে যাচ্ছে চাষের আওতায়। পতিত জমি না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে কাশবন আর কাশফুল। শরৎ মনে জাগিয়ে দেয় কাশফুল, স্বচ্ছ নীল আকাশে সাদা মেঘ আর দিগন্তবিস্তৃত সবুজের কথা। কাশফুলের গন্ধ নেই, কাশফুল প্রিয়জনের জন্য উপহার হিসেবে দেওয়ার ফুলও নয়। তবে কাশফুলের মধ্যে রয়েছে রোমাঞ্চকর উন্মাদনা। যা দেখে ব্যক্তিমন ভালো হয়ে যায়। কাশফুলের এই শুভ্রতা এবং স্নিগ্ধতা ছুঁয়ে যাক প্রতিটি হৃদয়। গ্রামাঞ্চলে অপরিকল্পিত দালানকোঠা, নদী ভাঙ্গন ও কৃষি চাহিদায় কাশফুল হারিয়ে যেতে বসছে। আবহাওয়াজনিত কারণে অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে শরৎকালে কাশফুলের তেমন দেখা মিলছে না।
মেহেন্দিগঞ্জ কাজীরহাটের বিদ্যানন্দপুর থেকে আসা আলম জানান, কাশফুলের বাগান দেখতে এসেছিলাম। অনেকের কাছেই শুনছিলাম খুব সুন্দর, সবাই দেখতে আসে। আজকে এসে দেখি সত্যিই নান্দনিক পরিবেশ। সবচেয়ে ভালো লেগেছে ঘুরেফিরে যখন ক্লান্ত তখন পাশেই দারুচিনি চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট চোখে পড়লো। গিয়ে দেখি চমৎকার পরিবেশ এবং হরেক রকম খাবারের সমাহার। আমি জানতামইরা এই জায়গায় শহরের মতো এতো সুন্দর খাবারের ব্যবস্থা আছে এবং খাবারের মানও যথেষ্ট ভালো।
মুলাদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সাইয়েদুর রহমান বলেন, এখানে শরতের কাশবন মাসের পর মাস ধরে দেখা যায়। এখানে প্রতিদিনই শতশত লোকজন আসে। এ এলাকাটি মৌসুমি পর্যটনকেন্দ্র হয়ে গেছে। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশী টহল দেখা যায়। দর্শনার্থীরা নিরাপত্তার সাথে এলাকায় ঘুরে আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। এ ছাড়াও ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, পুজোর ছুটি ছাড়াও অন্যন্য ছুটির দিনে এখানে দর্শনার্থীদের ভীড় জমে থাকে।